পাবনা রূপপুর যেন এক টুকরো রাশিয়া

পাবনা রূপপুর যেন এক টুকরো রাশিয়া

পাবনা রূপপুর যেন এক টুকরো রাশিয়া
পাবনা রূপপুর যেন এক টুকরো রাশিয়া

অনলাইন ডেস্ক: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাঙালিদের বসবাসে ‘মিনি বাংলাদেশ’ গড়ে ওঠার খবর চোখে পড়ে। এবার বাংলাদেশে দেখা মিলেছে এক টুকরা রাশিয়া। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পদ্মার তীরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পাঁচ হাজার রুশ নাগরিকের পদচারণায় এ পরিবর্তন এসেছে। স্থানীয় অর্থনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

রাশিয়ানদের বসবাসের কারণেই তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটার প্রয়োজন পড়ছে। তাদের জীবনধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিছু পণ্যের প্রয়োজন দেখা দেয়। তাদের সেসব চাহিদা মেটাতেই রূপপুরের ব্যবসায়িক চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করেছে। জাগো নিউজ

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেন। রাশিয়ার পরমাণু সংস্থা রোসাটোমের সহযোগিতায় রূপপুর প্রকল্পের কাজ চলছে। এ প্রকল্পে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা কাজ করছেন। প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। সর্বশেষ গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূলযন্ত্র পারমাণবিক চুল্লিপাত্র (রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল-আরএনপিপি) স্থাপনকাজের উদ্বোধন করেছেন।

প্রকল্পে কর্মরত রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও স্থানীয় কর্মচারীদের কর্মচাঞ্চল্যে বদলে যেতে শুরু করেছে রূপপুর এলাকার দৃশ্যপট। এখানকার বাজারঘাট, দোকানপাট, রেস্তোরাঁয় বদলে যাওয়ার হাওয়া লেগেছে। বাংলার পাশাপাশি রাশিয়ান ভাষারও প্রচলন শুরু হয়েছে। সাইনবোর্ডগুলোতে বাংলা ইংরেজির পাশাপাশি রাশিয়ান ভাষাও লেখা আছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চাহিদা বিবেচনায় নিজেদের ব্যবসাকে ঢেলে সাজাচ্ছেন। তারা রাশিয়ানদের রুচি ও চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে দোকানপাট সাজাতে শুরু করেছেন। সেলুন থেকে কাঁচাবাজার কিছুই বাদ যায়নি বদলে যেতে।

রূপপুর এলাকায় সেলুনের দোকান দিয়েছেন সেলিম হোসেন। তিনি বলেন, রাশিয়ানদের রুচি ও চাহিদা বুঝে তিনি দোকানে সেবা দেন। আগের চেয়ে তার লাভের পরিমাণটাও বেড়েছে।

ব্যবসায়ী কোরবান আলী বলেন, শুরুর দিকে তাদের রুশ ভাষা বুঝতে সমস্যা হতো। তারা কেনাবেচার সুবিধার্থে রুশ ভাষার প্রয়োজনীয় শব্দগুলো আয়ত্ত করেছেন। তিনি জানান, নিজেদের কেনাকাটার জন্য রাশিয়ানরাও কিছু বাংলা শব্দ শিখছেন। আরেক ব্যবসায়ী মানিক মিয়া বলেন, শুরুতে সমস্যা হলেও এখন আর তাদের সমস্যা হচ্ছে না।

একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করা আমিন আহমেদ বলেন, তারা রেস্তোরাঁ করে রাশিয়ানদের ভালো সাড়া পাচ্ছেন। তাদের খাবারের মেন্যু থেকে শুরু করে সব কিছুই তারা বুঝতে পারেন।

কাঁচাবাজার ও ফলের দোকানদার আরমান হোসেন বলেন, রাশিয়ানদের সঙ্গে তাদের অনেকটা সখ্য গড়ে উঠেছে। অনেকদিন ধরে দেখা-সাক্ষাতে তারা তাদের কাছে এখন আপনজন।

কথা হয় পাবনা শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও বনলতা গ্রুপের অন্যতম স্বত্বাধিকারী আলহাজ মাসুদ রানার সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বছরখানেক আগে রাশিয়ানরা ছুটির সময়ে পাবনা শহরে বাজার করতে আসতেন। তারা মেগাশপ, ফাস্টফুডসহ ফলের দোকানে ভিড় করতেন। তবে ইদানীং পাবনা শহরে তাদের পদচারণা কমেছে।

এর কারণ হিসেবে ঈশ্বরদীর বাসিন্দা মহসিন আলী বলেন, রূপপুর এলাকার ব্যবসায়ীরাই রুশ নাগরিকদের চাহিদামতো নানা পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন। তাদের চাহিদামতো কাঁচা তরকারিসহ সেলুন পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। বেশ কিছু অভিজাত রেস্তোরাঁ ও পারলার পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। শুধু দোকান নয় রুশ ভাষা শেখার কিছু প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। সেখানে দোভাষীর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দোকানপাটের বিষয়ে ধারণা দিতে দোকানিরা বাংলা, ইংরেজির পাশাপাশি রুশ ভাষায় সাইনবোর্ড করেছেন। তাদের কর্মচারীরাও রুশ ভাষার বহুল ব্যবহৃত বা এখানে প্রয়োজনীয় শব্দগুলো আয়ত্ত করে ফেলেছেন।

কয়েকজন রাশিয়ান নাগরিক দোভাষীর মাধ্যমে বলেন, তারা বাংলাদেশিদের আতিথেয়তায় চরম মুগ্ধ। বাংলাদেশ খুব সুন্দর দেশে বলে তারা মন্তব্য করেন।

পাবনা চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহ-সভাপতি আলী মর্তুজা বিশ্বাস সনি বলেন, রূপপুর প্রকল্প চালু হলে সারাদেশের মানুষ দীর্ঘমেয়াদে এর সুবিধা পাবেন। রাশিয়ানদের সঙ্গে ব্যবসা করে স্থানীয়রা উপকৃত হচ্ছেন। এটা দেশের সামগ্রিক উন্নতিতেও ভূমিকা রাখছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর বলেন, রুশ সংস্কৃতির সঙ্গে স্থানীয়দের খাপ খাওয়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। এগুলো দেশকে সমৃদ্ধ করছে।

তিনি বলেন, স্থানীয় উন্নয়ন এখনই চোখে পড়ছে। কোনো ওয়ার্কার এখন সাইকেলে আসেন না। বেশিরভাগের মোটরসাইকেল হয়েছে। প্রকল্প কাজ শেষে অর্থনৈতিক মানদণ্ডে এখানে একটা ‘মিনি রাশিয়া’ থেকেই যাবে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর প্রকল্পের রিঅ্যাক্টরসহ যাবতীয় যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে রাশিয়াতে। সেখানকার বিভিন্ন কারখানায় যন্ত্রগুলো তৈরি করে সমুদ্রপথে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। প্রথম ইউনিটের ভারী যন্ত্র চারটি স্টিম জেনারেটর, প্রেসারাইজার, হাইড্রো অ্যাকোমোডেটর এরই মধ্যে রূপপুর পৌঁছেছে। রিঅ্যাক্টর গতবছরের অক্টোবরে রাশিয়া থেকে দেশে পৌঁছায় এবং নভেম্বরের সেটি রূপপুর নেওয়া হয়।

চলতি বছরের আগস্টে দ্বিতীয় ইউনিটের রিঅ্যাক্টর এসেছে। ভারী এ যন্ত্রগুলো রাশিয়ার ভলগা নদী থেকে প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটার সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের মোংলা বন্দর দিয়ে রূপপুরের কাছে পদ্মায় পৌঁছায়। রিঅ্যাক্টর ভেসেলের ওজন ৩৩৩ দশমিক ৬ টন। এটি বানাতে দুই বছরের বেশি সময় লাগে।

স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরের মধ্যে রূপপুর প্রকল্পই দেশের সবচেয়ে বড় এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে সর্বাধিক ব্যয়বহুল প্রকল্প। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালে প্রথম ইউনিট থেকে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে আরও এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট, অর্থাৎ মোট দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

মতিহার বার্তা / ইএবি

খবরটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply